মুখগুলো
মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা [১৯৩২]
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
“এতো একদমই আমার মত দেখতে না। এ আমার সন্তান নয়। আমার সাথে কোন সম্পর্ক নেই এর।” বাচ্চাটির বাবা বলে উঠল।
পথের মাঝখানে কোথাও মেয়েটি আর ওর সন্তানের পথও আলাদা হ’য়ে গেল।
পরে একসময় মেয়েটি ভাবতে শুরু করল যে হয়ত সন্তানের মুখটি আসলে ওর মুখের মতই ছিল।
(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
সেই ছয়, সাত বছর বয়স থেকে শুরু করে চোদ্দ, পনেরো বছর হওয়া পর্যন্ত মেয়েটি মঞ্চে উঠে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। ওই সব দিনে দর্শকরাও প্রায়ই কাঁদত।
মেয়েটি কাঁদলে সব সময়ই দর্শকরা কাঁদবে - নিজের জীবন সম্বন্ধে ওর প্রথম ধারণাটাই ছিল এমন। মানুষের মুখগুলো দেখলে ওর মনে হ’ত এইসব মুখ যেন ওকে মঞ্চে দেখে কেঁদে ফেলবার জন্যই। একটাও এমন মুখ ছিল না যা ও বুঝতে পারত না। ফলে অনায়াসেই পৃথিবীর মুখটাকে কেমন যেন খুব সহজ আর বোধগম্য বলে মনে হ’ত।পুরো নাটকের দলে এমন কোন অভিনেতা ছিল না যে কিনা এই শিশু অভিনেত্রীর মত এত দর্শককে কাঁদাতে পারত।
যাহোক, ষোল বছর বয়সে মেয়েটি একটি বাচ্চার জন্ম দিল।“এতো একদমই আমার মত দেখতে না। এ আমার সন্তান নয়। আমার সাথে কোন সম্পর্ক নেই এর।” বাচ্চাটির বাবা বলে উঠল।
“দেখতে এ আমার মতও নয়,” অল্পবয়সী মেয়েটি বলল। “কিন্তু তবু এ আমারই সন্তান।”
কন্যার এই মুখটিই প্রথম মুখ যা মেয়েটি বুঝতে পারল না। তা হয়ত তোমরা বলবে যে সন্তানের জন্ম দিয়ে শিশু অভিনেত্রী হিসেবে মেয়েটির জীবন একরকম নষ্টই হয়ে গেল। কেননা ঠিক তখনই ও যেন বুঝতে পারল যে নাটকের মঞ্চে কেঁদে কেঁদে এতদিন এত লোকের চোখে যে জল ও এনেছে, তার সাথে বাস্তব পৃথিবীর আসলে এক বিরাট ফাঁক। ওই ফাঁকটুকুর দিকে তাকাতেই কেমন যেন মনে হ’ল সে গর্ত বুঝি এক ঘন কালো অন্ধকারে ঢাকা। সেই অন্ধকারে ভেসে উঠল অগুনতি, অবোধগম্য মুখ - মেয়েটির নিজ সন্তানের মত ।পথের মাঝে কোথাও মেয়েটি বাচ্চাটার বাবাকে ফেলে রেখে চলে গেল।
তারপর, যতই বছরগুলো কেটে যেতে থাকল, ওর মনে হ’ল বাচ্চাটার মুখটা যেন সেই ফেলে আসা মানুষটিরই মত।
ধীরে ধীরে, মেয়েটির কন্যার অভিনয় দর্শকদের চোখ জলে ভরে দিতে শুরু করল। ঠিক যেভাবে একদিন অল্প বয়সে ওর অভিনয়ও কাঁদাত মানুষকে। তারপর, যতই বছরগুলো কেটে যেতে থাকল, ওর মনে হ’ল বাচ্চাটার মুখটা যেন সেই ফেলে আসা মানুষটিরই মত।
পথের মাঝখানে কোথাও মেয়েটি আর ওর সন্তানের পথও আলাদা হ’য়ে গেল।
পরে একসময় মেয়েটি ভাবতে শুরু করল যে হয়ত সন্তানের মুখটি আসলে ওর মুখের মতই ছিল।
প্রায় বছর দশেক পর, অবশেষে মেয়েটির নিজের বাবার সাথে দেখা হ’ল । গ্রামের এক নাট্যশালায়। বাবা একজন ভ্রাম্যমান অভিনেতা। বাবার কাছে ও মা-র খোঁজ পেল।
মা-র কাছে গেল মেয়েটি। মায়ের মুখের দিকে এক ঝলক তাকাতেই, কেঁদে ফেলল ও। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাকে আঁকড়ে ধরল মেয়ে। নিজ মাকে জীবনে প্রথমবারের মত দেখল ও। এবং জীবনে এই প্রথমবারের মত সত্যিকারের চোখের জল ফেলল মেয়েটি।নিজের যে মেয়েকে পথের মাঝখানে ছেড়ে এসেছিলো, মনে হ’ল সেই মেয়ের মুখ যেন একদম পুরোপুরি মায়ের মুখের মত। মেয়েটি নিজে ওর মায়ের মত দেখতে ছিল না। তাই মেয়েটি আর ওর সন্তানের চেহারাও আলাদারকম মনে হয়েছিলো। কিন্তু দিদিমা আর নাতনির চেহারা যে আসলে হুবহু এক।
যখন মার বুকে মুখ গুঁজে মেয়েটি কাঁদছিল, ও যেন বুঝতে পারল যে শিশু অভিনেত্রী হয়ে সেই ছেলেবেলা থেকে আসলে ও সত্যি সত্যিই কেঁদে চলেছে।
ঠিক তখন মেয়েটি নিজের মেয়ে আর তার বাবাকে খুঁজে মুখগুলোর গল্প বলতে ওই ভ্রাম্যমান অভিনেতাদের দলে ফিরে গেল। ঠিক যেভাবে কোন তীর্থযাত্রীর হৃৎপিণ্ড ছুটে যায় পুণ্যভূমির দিকে।
(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)
...একাকীত্ব,ভালোবাসা আর অনুভূতির সূক্ষ্ণতায় কবিতার মত। - ঠিক তাই। আমার মত মোটা বুদ্ধির মানুষের জন্য ভীষণ সূক্ষ।
উত্তরমুছুনকিন্তু মেয়েটার মত কান্না পাচ্ছিল পড়তে পড়তে। যারা নাকি গল্প পড়ে কাঁদে তারা বাস্তবে কাঁদতে জানেনা। "..... নাটকের মঞ্চে কেঁদে কেঁদে এতদিন এত লোকের চোখে যে জল ও এনেছে, তার সাথে বাস্তব পৃথিবীর আসলে এক বিরাট ফাঁক।"
সত্যি সত্যি কাঁদতে পারলে কত ভালো হতো।