মরণ-মুখোশ*
মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা [১৯৩২]
“তা ঠিক,” বিষন্ন মুখ শিল্পীর। “আসলে কি জান? কখনো যদি কোন ‘মরণ-মুখোশ’ দেখ, আর মানুষটি কে ছিল তা ঠিক না জান, তুমি কিন্তু কিছুতেই বলতে পারবে না যে সেই মানুষটি পুরুষ ছিল না নারী। বীঠোফেনের মত পুরুষালি মুখের ‘মরণ-মুখোশ’-এর দিকেও যদি তাকিয়ে থাক, দেখো মনে হবে বুঝি এক নারীর মুখ দেখছ...তবু জানো, আমি কিন্তু ভেবেছিলাম এই নারীর ‘মরণ-মুখোশ’-টি অন্ততঃ মেয়েলি হবে। ওর থেকে বেশি নারীত্ব তো কোনদিন ফুটে ওঠেনি আর কোন মেয়ের ভিতর। তবু দেখ অন্যদের মতই হ’ল। এই নারীও মরণকে মেরে ফেলতে পারল না তো। অথচ নারী পুরুষের সব পার্থক্য তো মৃত্যুতে এসেই শেষ হয়।
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
(অটোয়া থেকে বের হওয়া ‘আশ্রম’ পত্রিকার ‘নভেম্বর, ২০১১’ সংখ্যায় প্রকাশিত।)
এর আগে মেয়েটির যে ঠিক কতজন প্রেমিক ছিল, ছেলেটি জানত না। তবে সে যাই হোক, ও যে মেয়েটির শেষ প্রেমিক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কেননা মৃত্যু এগিয়ে আসছে।
“যদি জানতাম এত তাড়াতাড়ি মরে যাব, তবে আমাকে মেরে ফেলা হোক – এমনটাই চাইতাম। সেই কবে!” উজ্জ্বল, ঝলমলে হাসি ওর। এমন কি ছেলেটি যখন ওকে জড়িয়ে, আঁকড়ে ধরেছিল - তখনও ফেলে আসা সব পুরুষদের ছবিই যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল মেয়েটির চোখে ।
সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তবু মেয়েটি ভুলে যেতে পারছে না নিজ সৌন্দর্য। ভুলতে পারছে না নিজের অসংখ্য প্রেমের কথাও। ওইসব স্মৃতি ওর মুখে যে বেদনার ছায়া ফেলছে, বুঝতে পারছে না তাও।
“সব ক’জন পুরুষ আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু সেটাই ওদের মনের কথা ছিল।”
মেয়েটি মারা যাচ্ছে। এখন ওকে বাহুর মধ্যে আঁকড়ে ধরে আছে যে, তার আর কোন ভয় নেই। এই মেয়েকে অন্য কারো কাছে হারাতে হবে না। কত কষ্টই না পেয়েছে সবাই মেয়েটিকে হারিয়ে ফেলতে হবে ভেবে ভেবে। তাদের সকলের চেয়ে অনেক ভাগ্যবান এই পুরুষ। একেবারে হত্যা না করে মেয়েটির হৃদয় জয় করবার কোন পথই যেন ওদের সামনে ছিল না। তবু মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেল পুরুষটি। উন্মাতাল মেয়েটির প্রেম। যখন অসুস্থ হ’ল, এমনকি তখনও কোন পুরুষ হাতের ছোঁওয়া ওর গলা বা বুকের উপর না থাকলে, শান্তিতে ঘুমাতে পারত না তো ও।
ধীরে ধীরে অবস্থা আরো খারাপ হ’ল।
“আমার পাগুলো ছুঁয়ে থাক। বড় একা একা পাগুলো। সহ্য করতে পারিনা।”
নিঃসঙ্গ মনে হ’ল পাগুলোকে। যেন আঙ্গুল বেয়ে বেয়ে মৃত্যু উঠে আসছে। পুরুষটি মেয়েটির বিছানার পায়ের কাছে বসে ওর পা শক্ত করে চেপে ধরে থাকল। মৃত্যুর মতই ঠান্ডা সে পা। পুরুষটির হাত হঠাৎ করে অস্বাভাবিক কেঁপে উঠল। ছোট ছোট পায়ের ভিতর দিয়েও যেন এই জীবন্ত নারীকে অনুভব করতে পারছে ও। একদিন এই পা উষ্ণ আর ভেজা ছিল। আজ পায়ের তলা ছুঁতেই ছোট, ছোট ঠান্ডা পাগুলো তবু কিভাবে যেন সেই একই আনন্দ বয়ে আনল। পুরুষটির হাতের পাতায় ফিরে এল কবেকার উষ্ণতা। খুব কাছে এগিয়ে আসছে মৃত্যু। তবু মৃত্যুর পবিত্রতাকে নষ্ট করে দেওয়া এই অনুভূতি। লোকটির মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। কি জানি, পা ছুঁয়ে বসে থাকবার ওই অনুরোধটুকু হবে হয়ত মেয়েটির প্রেমেরই শেষ ছলনা। এই অসহ্য মেয়েলিপনায় ভয় পেয়ে গেল লোকটি।
“এখন আর কাউকে ঈর্ষা করবার দরকার নেই। তাই ব’লে আমাদের প্রেমে একটা কোন ফাঁক থেকে যাচ্ছে, এমনটা ভেব না। যখন মরে যাব, দেখ একটা কোন ঈর্ষার কারণ তোমার ঠিকই ঘটে যাবে, কিছু না কিছু থেকে,” এই কথা বলে শেষ নিঃশ্বাস ফেলল মেয়েটি।
মেয়েটি যেমন বলেছিল, ঠিক তেমনই ঘটল।
মৃতের পাশে সারারাত জেগে বিলাপ করছিলো সবাই। এমনই প্রথা। নতুন নাট্যশালা থেকে এক অভিনেতা সেখানে এল। সে মৃত নারীটির মুখে প্রসাধন লাগিয়ে গেল। যেন মেয়েটিকে আবার জীবন ফিরিয়ে দেবে। যেন আর একবার হলেও ফিরিয়ে আনবে বিশুদ্ধ, সজীব, প্রাণোচ্ছল সেই সৌন্দর্য। যেদিন মেয়েটির প্রেমে অভিনেতাটি বিভোর ছিল, ঠিক তখন যে সৌন্দর্য ছিল এই মেয়ের।
তারপর এল এক শিল্পী। নারীটির মুখের উপর পলেস্তারার প্রলেপ দিতে থাকল ও। আগের অভিনেতা যে প্রসাধন দিয়েছিল, তাতে নারীর মুখটাকে এত জীবন্ত লাগছিল। অভিনেতার প্রতি হিংসায় ভরে গেল মন। শিল্পী তখন এমনভাবে ওর মুখটাকে প্লাস্টার করতে থাকল যে মনে হ’ল এবার বুঝি দমবন্ধ করেই মেরে ফেলবে সে এই নারীকে। অথচ মেয়েটির মুখ মনে রাখবার জন্যই এই ‘মরণ-মুখোশ’-টি গড়ছিল শিল্পী ।
বেঁচে থাকতে প্রেমের যে যুদ্ধ নারীটির জীবনে ছিল, মরণেও তা শেষ হ’ল না। এইসব দেখে পুরুষটি বুঝতে পারল এই নারী ওর হাতের উপর মারা গেলেও আসলে তা শুধু এক ক্ষণিক বিজয়। শিল্পীর বাড়িতে ওই ‘মরণ-মুখোশ’ আনতে গিয়ে এমনই বিশ্বাস হ’ল ওর।
অথচ এই ‘মরণ-মুখোশ’-টি দেখতে পুরুষের মত, দেখতে নারীর মত। এই ‘মরণ-মুখোশ’ এক অল্প বয়েসী মেয়ের মত, এক বৃদ্ধ মহিলার মত। পুরুষটির গলার স্বর শুনে মনে হ’ল যেন ওর বুকের ভিতরের আগুনটুকুও নিভে গেছে এবার।
“এ তো সেই মেয়ে-ই, তবুও এ তো সে নয়। প্রথম দেখে আমি কিছুতেই বুঝতে পারি নি যে এই ‘মরণ-মুখোশ’-টি আসলে নারীর না পুরুষের।”
“তা ঠিক,” বিষন্ন মুখ শিল্পীর। “আসলে কি জান? কখনো যদি কোন ‘মরণ-মুখোশ’ দেখ, আর মানুষটি কে ছিল তা ঠিক না জান, তুমি কিন্তু কিছুতেই বলতে পারবে না যে সেই মানুষটি পুরুষ ছিল না নারী। বীঠোফেনের মত পুরুষালি মুখের ‘মরণ-মুখোশ’-এর দিকেও যদি তাকিয়ে থাক, দেখো মনে হবে বুঝি এক নারীর মুখ দেখছ...তবু জানো, আমি কিন্তু ভেবেছিলাম এই নারীর ‘মরণ-মুখোশ’-টি অন্ততঃ মেয়েলি হবে। ওর থেকে বেশি নারীত্ব তো কোনদিন ফুটে ওঠেনি আর কোন মেয়ের ভিতর। তবু দেখ অন্যদের মতই হ’ল। এই নারীও মরণকে মেরে ফেলতে পারল না তো। অথচ নারী পুরুষের সব পার্থক্য তো মৃত্যুতে এসেই শেষ হয়।
“এই মেয়েটির পুরো জীবনটাই ছিল নারীজন্মের সেই গভীর আনন্দের এক করুণ নাটক। আসলে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ও সত্যিই বড় বেশি নারী ছিল।” লোকটি নিজের হাত বাড়িয়ে দিল, যেন এক দুঃস্বপ্ন শেষ হ’ল। “অবশেষে এই মর্মান্তিক নাটক থেকে ও যদি মুক্তি পেল, তবে এস, এই ‘মরণ-মুখোশ’-এর সামনেই আমরা হাত মিলাই। এই তো সেই ‘মরণ-মুখোশ’ যেখানে এক নারীকে এক পুরুষ থেকে কিছুতেই আর আলাদা করা যায় না।”
(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)* ‘মরণ-মুখোশ’ : অনেক সমাজে মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির মুখের ছাঁচ তৈরী করা হয়। স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাখবার জন্য মোম দিয়ে বা প্লাস্টার করে তৈরী হয় এই ছাঁচ।
"এই তো সেই ‘মরণ-মুখোশ’ যেখানে এক নারীকে এক পুরুষ থেকে কিছুতেই আর আলাদা করা যায় না।"
উত্তরমুছুন- ওয়াও, কি গভীর সত্য উন্মোচন। ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা-র ভক্ত হয়ে পড়ছি আমি। সে সাথে আপনার এই অসাধারণ অনুবাদ্গুলোরও।
ভাল থাকুন। আরো নিয়ে আসুন আমাদের জন্য। শুভেচ্ছা।
শামান সাত্ত্বিক
onek, onek dhonyobad!
উত্তরমুছুনhya, amio to ektu Kawabata-r lekhay neshagrosto ashole!
jodio onubad-gulo niye ektu chinta achhe. bisheshoto ei onubad ta niye onek vuglam mone holo. dishehara hoye apatoto hal chhere dilam.
hoyto abar pore shobgulo-ke dhore thik kora jabe. kono ekdin...
Khub bhalo laglo Kalyani - besh abstract ekta chNoa pawa gelo - tomar anubad-o asadharon.
উত্তরমুছুনএই টা আমার সব চেযে় প্রিয় লেখা .. অসাধারণ ... মাথা টা ফেটে গেল একে বারে - সুজাতা
উত্তরমুছুনভাল লাগল। ভাল অনুবাদ।
উত্তরমুছুন