পৃথিবী
মূলঃ
ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা [ ১৯ ৬৩]
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
[পৃথিবী’ গল্পটি কাওয়াবাতা-র ‘পাম অফ দ্যা হ্যান্ড স্টোরিস’ বই থেকে নেওয়া।‘পাম অফ দ্যা হ্যান্ড স্টোরিস’ বই-এর এই গল্পগুলো সম্বন্ধে কাওয়াবাতা বলেছেন, ‘অনেক লেখক কবিতা দিয়ে তাঁদের লেখক জীবন শুরু করেন। আমি নিজে কবিতার বদলে লিখে গেছি ছোট গল্প। আমার তরুণ জীবনের কবিসত্ত্বা বেঁচে আছে এই গল্পগুলোর মধ্যেই।’
‘হাইকু’ যেমন বড় কবিতার সমস্ত সৌন্দর্য মাত্র তিন পংক্তির ভিতর ফুটিয়ে তোলে, কাওয়াবাতার ছোট গল্পগুলোও ঠিক তেমনি। নর-নারীর সম্পর্কের জটিলতা, প্রেম, এবং মানুষের জীবনের বিশাল পরিসর - সব, সব ফুটে উঠেছে এখানে।]
১
“এক নারী – সূর্যের পোশাক শরীরে, পায়ের নীচে চাঁদ আর মাথায় তার বারোটি তারার মুকুট। সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে ও। সৃষ্টির সে পথে প্রসব যন্ত্রণায় কাঁদছে ওই নারী।”
২
“আমি কিছু বুঝতে পারবার আগেই রাস্তার পাশে একটা ছোট ক্যাথলিক চার্চ তৈরী হচ্ছিল। রাস্তাটা চলে গেছে আটা পেষার কলে জলের উপর ঘুরে চলা ওই কাঠের চাকাটার ধার ঘেঁষে। এই সেই পথ যার পাশ দিয়ে বহুদিন আগে আমি হাঁটতে ভালোবাসতাম। তাছাড়া ওই খাড়া উঠে যাওয়া বরফ-ঢাকা ছাদের নীচে চার্চের সুন্দর, অমসৃণ, কাঠের দেয়ালগুলো ইতিমধ্যেই কয়লার ঝুল লেগে কালো হয়ে গেছে।” এ কথা লেখা আছে হোরি তাতসুর এক গল্পতে। সেন্ট পল-এর চার্চটার ছাদ টালি দিয়ে ঢাকা। ভিতর থেকে দেখে মনে হয় বুঝি তা প্রার্থনারত দু’টো হাত। আর হ্যাঁ, বেদির উপরের ক্রুশচিহ্নটিও কাঠেরই তৈরি।
৩
হোরি তাতসু এই কথাগুলো লিখে যাবার পর পঁচিশটা বছর কেটে গেছে। পঁচিশ বছর পর এই এখন অল্পবয়েসী এক নারী আর পুরুষ হেঁটে যাচ্ছে সেখান দিয়ে। ওদের পরনে এমন পোশাক যা সাধারণতঃ দেখা যায় কারুইজায়া শহরে- গরমকালের দুপুরবেলা।
“এই চার্চের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার মা-কে এক ভয়ংকর কথা শুনতে হয়েছিল।” অল্পবয়েসী পুরুষটি চলা থামাল। অল্পবয়েসী নারীটির সাথে কথা বলতে গিয়ে সে চার্চের দিকে তাকাল। নারীটিও চার্চের দিকে ফিরে দেখল; তারপর সে তাকাল তরুণটির মুখের দিকে।
“কিন্তু তুমি তো তোমার মা-কে বিশ্বাস কর। আর যেহেতু মা-কে বিশ্বাস কর, তোমার নিঃসন্দেহে বাবা আছে।”
তরুণটি কোন কথা বলল না।
“আমি এমন এক সন্তান যার বাবা নেই- নিশ্চিত কোন বাবা নেই। এবং যার নিজ মা-কে বিশ্বাস করবারও কোন পথ নেই,” মেয়েটি বলে চলল।
“এমন নয় যে মা-কে বিশ্বাস করে তুমি তোমার বাবাকে জানতে পারবে। যদি বাবা মা-কে বিশ্বাস না করে, যদি বাবাও মা-কে সন্দেহ করে, তখন তো আসলে সবকিছুই অনিশ্চিত।”
“কিন্তু, ধর, অবিশ্বাস করবার জন্য হ’লেও তোমার একজন বাবা আছে যাকে তুমি অবিশ্বাস করতে পার। কোন কল্পনার মোহ-র ভিতরও তো আমার কোন বাবা নেই। মাঝে মাঝে ভাবি ওই জেলখানাটাই হয়ত আমার বাবা।”
“বাবার সাথে মিল আছে এমন কিছুই আমার ভিতর নেই।”
“তা ঠিক। কোন মিল নেই। কিন্তু তোমার সাথে তো তোমার মা’র ও মিল নেই।”
“কেন এমন বল তো?”
৪
“এ সন্তান আমার নয়। কি জানি কে বলতে পারে কার?”
গর্ভবতী হয়েছে এই কথা বলবার সাথে সাথে স্বামীর কাছ থেকে এই ভয়ংকর কথাটা শুনেছিল তরুণটির মা। প্রায় বছর কুড়ি আগে ওরা এই চার্চের সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল।
অল্পবয়েসী সেই নারী শুধু একটি পুরুষকেই জানত, ফলে প্রচন্ড ভয় আর ধাক্কা খেল সে। এমন কি নিজের সতীত্ব প্রমাণ করবার মত শক্তিও নারীটির আর থাকল না। নিজ স্বামী যদি ওর কথা অবিশ্বাস করে, তবে আর কোন আশ্রয় আছে ওর?
প্রমাণ দেখাতে নারীটি পেটের বাচ্চাটিকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি গেল।
“নাহ্, এ আমার সন্তান নয়। কে জানে কার।” আবার অস্বীকার করল সে বাচ্চাটিকে। “এই সন্তান ব্যভিচারের ফল।”
অল্পবয়েসী নারীটির মাথা খারাপ হয়ে গেল এবং সে পাশেই পড়ে থাকা পর্বতারোহীর একটা ছুরি দিয়ে নিজের সন্তানকে খুন করতে গেল। পুরুষটি নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিতে গিয়ে স্ত্রীর গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল। তখন নারীটি বাচ্চাটার বাবার গায়েই ছুরি বসিয়ে দিল।
ঠিক সেই মুহুর্তে এই সতী সাধ্বী নারীর হৃদয়ে এক প্রতিচ্ছবি ঝিলিক দিয়ে উঠল। যেন বিদ্যুত্-এর আলোয় ঝলমল করে। মাটির নীচের চ্যাপেল-এ দেওয়ালের গায়ে আঁকা ছিল সেই ছবি। ছবিটা ব্যভিচারের পরিণাম নিয়ে সর্তক করে দিয়ে। দু’টো শাদা সাপ এক নারীর স্তনযুগল থেকে ঝুলে আছে, ছোবল মারছে বুকে। আর যীশুর হাত থেকে একটা বর্শা নারীটির একটা স্তনের মাঝ দিয়ে বুক ফুঁড়ে ভিতরে চলে গেছেঃ প্রভু যীশু নারীটিকে হত্যা করছেন। মেয়েটি ভয়ে চীত্কার করে উঠল।
স্বামীর ক্ষতটি ভয়াবহ ছিল। নারীটিকে ক্ষমা করবার বদলে পুরুষটি আর তার পরিবার পুলিশকে সব জানাল। ফলে নারীটিকে গ্রেফতার করা হ’ল।
৫
নারীটি যখন জেলখানার অন্যান্য কয়েদিদের সাথে ছিল, স্বর্গের দরজা খুলে গেল এবং মেয়েটি ঈশ্বরের ছায়া দেখতে পেল।
৬
যখন নারীটি জেলখানায় ছিল, আর একজন অল্পবয়েসী মেয়েকে জেলখানায় কয়েদি করা হ’ল। এই অল্পবয়েসী মেয়েটি নিজের প্রেমিক-কে হিংসায় কান্ডজ্ঞানহারা হ’য়ে খুন করেছে। যখন মেয়েটি জানল যে নারীটির একটি সন্তান আছে, তখন তাকেও খুব ঈর্ষা করতে শুরু করল মেয়েটি।
“আমি আমার প্রেমিকের সন্তানের জন্ম দিতে চেয়েছিলাম খুব, কিন্তু এখন আর তা পারব না – আমি ওকে খুন করেছি।” নারীটিকে আঁকড়ে ধরে খুব কাঁদল মেয়েটি। “আর হবে না। এই জীবনে না। কোনদিন কারও সন্তানের জন্মই আমি আর দিতে পারব না। আমার জীবন এই জেলখানাতেই কেটে যাবে। আর যতদিনে জেলখানা থেকে বের হ’ব ততদিনে আমার এত বয়স হয়ে যাবে! সন্তানের জন্ম দেওয়ার সেই বয়স তো আর থাকবে না। একজন নারীর সেটাই তো মৃত্যুদন্ড। যখনই আমি এইকথা ভাবি, মনে হয় যদি কোনভাবে, যে কারও সন্তানের জন্ম যদি দিতে পারতাম। যে কোনভাবে।”
“যে কোনভাবে?”
“হ্যাঁ, যে কারও সন্তান।”
“তাই নাকি? এ কথা যদি সত্যি হয়, তবে আমি কি সেই চেষ্টা করব যাতে তুমি গর্ভবতী হও?”
“ কিন্তু তুমিও তো একজন নারী।”
“আমি কিছুদিনের ভিতরই এখান থেকে বের হ’ব। ততদিন অপেক্ষা কর। আমি তোমার সন্তানের জন্ম দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
৭
নারীটি জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যে মেয়েটি জেলখানায় পিছনে পড়ে থাকল, তাকে দেখতে এল।
জেলখানার মেয়েটি গর্ভবতী হ’ল।
এই ঘটনায় সারা জেলখানায় শোরগোল পড়ে গেল। নারীটি কিছুতেই স্বীকার করল না যে কার সন্তান এটা। আসলে এও সত্য যে এমন কোন পথই খোলা থাকল না যা দিয়ে নারীটি সে চেষ্টাটুকু শুরুও করতে পারে। জেলখানার সব প্রহরী এবং সব পুরুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হ’ল। কিন্তু নারী কয়েদিদের সব প্রহরীরাও মহিলা ছিল। কোন পুরুষ ওই নারীদের কাছে আসেনি। আর নারীটি কোনভাবেই জেলখানার বাইরেও যায়নি।
যে নান জেলখানার উপাসনাগারের দায়িত্বে ছিল সে একবারও বলল না যে এটা কোন এক অলৌকিক ঘটনা। কিংবা এমনও বলল না যে এ কোন পবিত্র আত্মার কাজ, কিংবা এবার কোন ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম হবে।
প্রশান্তিতে ভেসে গিয়ে নারীটি ওই শিশু কন্যাকে জেলখানার ভিতর বুকের দুধ খাইয়ে বড় করতে থাকল। সে তার বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখল।
অল্পবয়েসী অন্য নারীটি তাকে দেখতে আর দ্বিতীয়বার এল না।
৮
বাচ্চা মেয়েটিকে দত্তক নিল কেউ, সে সুখী হয়ে বড় হ’য়ে উঠতে থাকল। এই সেই মেয়ে যে এখন সেন্ট পল চার্চের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যখনই ইচ্ছে করত, তখনই সে নিজের আপন মা-কে দেখতে যেতে পেত। মা এখন জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছে। মেয়েটি জেলখানার ওই গরাদের ভিতর ওর নিজের জন্মকথা শুনেছে।
যে অল্পবয়েসী তরুণটি মেয়েটির সাথে এখন হাঁটছে, সে হচ্ছে সেই শিশু যাকে তার মা মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছিল। অবশেষে তরুণটির বাবা তার মাকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। ওদের আবার ভাব হয়ে গিয়েছিল এবং এখনও তারা একসাথেই আছে।
“যে আমাকে রক্ষা করেছিল আর নিজে আহত হয়েছিল, সেই বুঝি আমার বাবা?” তরুণটি স্বপ্নাচ্ছন্নভাবে বলল।
“ঠিক তাই।” মেয়েটি মাথা নাড়ল।“ আর আমি হচ্ছি সেই শিশু যার নিজের কোনদিন কোন বাবা ছিল না। সেই আমি আজ এমন এক সন্তানের জন্ম দেব যার পিতা আছে।”
তরুণটিও চার্চের সামনের রাস্তা ধরে যেতে যেতে মাথা নেড়ে সায় দিল।
৯
“আর সেই সাপটার মুখ থেকে বন্যার মত জলের স্রোত বেরিয়ে এল। সেই বন্যায় নারীটি যেন ভেসে যেতে নিল। পৃথিবী নারীটিকে সাহায্য করল। পৃথিবী নিজের বিবরে সেই বন্যার জল শুষে নিল। যে জল ওই ড্রাগনটা নিজের মুখ থেকে উগড়ে দিয়েছিল।”
(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
[পৃথিবী’ গল্পটি কাওয়াবাতা-র ‘পাম অফ দ্যা হ্যান্ড স্টোরিস’ বই থেকে নেওয়া।‘পাম অফ দ্যা হ্যান্ড স্টোরিস’ বই-এর এই গল্পগুলো সম্বন্ধে কাওয়াবাতা বলেছেন, ‘অনেক লেখক কবিতা দিয়ে তাঁদের লেখক জীবন শুরু করেন। আমি নিজে কবিতার বদলে লিখে গেছি ছোট গল্প। আমার তরুণ জীবনের কবিসত্ত্বা বেঁচে আছে এই গল্পগুলোর মধ্যেই।’
‘হাইকু’ যেমন বড় কবিতার সমস্ত সৌন্দর্য মাত্র তিন পংক্তির ভিতর ফুটিয়ে তোলে, কাওয়াবাতার ছোট গল্পগুলোও ঠিক তেমনি। নর-নারীর সম্পর্কের জটিলতা, প্রেম, এবং মানুষের জীবনের বিশাল পরিসর - সব, সব ফুটে উঠেছে এখানে।]
১
“এক নারী – সূর্যের পোশাক শরীরে, পায়ের নীচে চাঁদ আর মাথায় তার বারোটি তারার মুকুট। সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে ও। সৃষ্টির সে পথে প্রসব যন্ত্রণায় কাঁদছে ওই নারী।”
২
“আমি কিছু বুঝতে পারবার আগেই রাস্তার পাশে একটা ছোট ক্যাথলিক চার্চ তৈরী হচ্ছিল। রাস্তাটা চলে গেছে আটা পেষার কলে জলের উপর ঘুরে চলা ওই কাঠের চাকাটার ধার ঘেঁষে। এই সেই পথ যার পাশ দিয়ে বহুদিন আগে আমি হাঁটতে ভালোবাসতাম। তাছাড়া ওই খাড়া উঠে যাওয়া বরফ-ঢাকা ছাদের নীচে চার্চের সুন্দর, অমসৃণ, কাঠের দেয়ালগুলো ইতিমধ্যেই কয়লার ঝুল লেগে কালো হয়ে গেছে।” এ কথা লেখা আছে হোরি তাতসুর এক গল্পতে। সেন্ট পল-এর চার্চটার ছাদ টালি দিয়ে ঢাকা। ভিতর থেকে দেখে মনে হয় বুঝি তা প্রার্থনারত দু’টো হাত। আর হ্যাঁ, বেদির উপরের ক্রুশচিহ্নটিও কাঠেরই তৈরি।
৩
হোরি তাতসু এই কথাগুলো লিখে যাবার পর পঁচিশটা বছর কেটে গেছে। পঁচিশ বছর পর এই এখন অল্পবয়েসী এক নারী আর পুরুষ হেঁটে যাচ্ছে সেখান দিয়ে। ওদের পরনে এমন পোশাক যা সাধারণতঃ দেখা যায় কারুইজায়া শহরে- গরমকালের দুপুরবেলা।
“এই চার্চের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার মা-কে এক ভয়ংকর কথা শুনতে হয়েছিল।” অল্পবয়েসী পুরুষটি চলা থামাল। অল্পবয়েসী নারীটির সাথে কথা বলতে গিয়ে সে চার্চের দিকে তাকাল। নারীটিও চার্চের দিকে ফিরে দেখল; তারপর সে তাকাল তরুণটির মুখের দিকে।
“কিন্তু তুমি তো তোমার মা-কে বিশ্বাস কর। আর যেহেতু মা-কে বিশ্বাস কর, তোমার নিঃসন্দেহে বাবা আছে।”
তরুণটি কোন কথা বলল না।
“আমি এমন এক সন্তান যার বাবা নেই- নিশ্চিত কোন বাবা নেই। এবং যার নিজ মা-কে বিশ্বাস করবারও কোন পথ নেই,” মেয়েটি বলে চলল।
“এমন নয় যে মা-কে বিশ্বাস করে তুমি তোমার বাবাকে জানতে পারবে। যদি বাবা মা-কে বিশ্বাস না করে, যদি বাবাও মা-কে সন্দেহ করে, তখন তো আসলে সবকিছুই অনিশ্চিত।”
“কিন্তু, ধর, অবিশ্বাস করবার জন্য হ’লেও তোমার একজন বাবা আছে যাকে তুমি অবিশ্বাস করতে পার। কোন কল্পনার মোহ-র ভিতরও তো আমার কোন বাবা নেই। মাঝে মাঝে ভাবি ওই জেলখানাটাই হয়ত আমার বাবা।”
“বাবার সাথে মিল আছে এমন কিছুই আমার ভিতর নেই।”
“তা ঠিক। কোন মিল নেই। কিন্তু তোমার সাথে তো তোমার মা’র ও মিল নেই।”
“কেন এমন বল তো?”
৪
“এ সন্তান আমার নয়। কি জানি কে বলতে পারে কার?”
গর্ভবতী হয়েছে এই কথা বলবার সাথে সাথে স্বামীর কাছ থেকে এই ভয়ংকর কথাটা শুনেছিল তরুণটির মা। প্রায় বছর কুড়ি আগে ওরা এই চার্চের সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল।
অল্পবয়েসী সেই নারী শুধু একটি পুরুষকেই জানত, ফলে প্রচন্ড ভয় আর ধাক্কা খেল সে। এমন কি নিজের সতীত্ব প্রমাণ করবার মত শক্তিও নারীটির আর থাকল না। নিজ স্বামী যদি ওর কথা অবিশ্বাস করে, তবে আর কোন আশ্রয় আছে ওর?
প্রমাণ দেখাতে নারীটি পেটের বাচ্চাটিকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি গেল।
“নাহ্, এ আমার সন্তান নয়। কে জানে কার।” আবার অস্বীকার করল সে বাচ্চাটিকে। “এই সন্তান ব্যভিচারের ফল।”
অল্পবয়েসী নারীটির মাথা খারাপ হয়ে গেল এবং সে পাশেই পড়ে থাকা পর্বতারোহীর একটা ছুরি দিয়ে নিজের সন্তানকে খুন করতে গেল। পুরুষটি নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিতে গিয়ে স্ত্রীর গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল। তখন নারীটি বাচ্চাটার বাবার গায়েই ছুরি বসিয়ে দিল।
ঠিক সেই মুহুর্তে এই সতী সাধ্বী নারীর হৃদয়ে এক প্রতিচ্ছবি ঝিলিক দিয়ে উঠল। যেন বিদ্যুত্-এর আলোয় ঝলমল করে। মাটির নীচের চ্যাপেল-এ দেওয়ালের গায়ে আঁকা ছিল সেই ছবি। ছবিটা ব্যভিচারের পরিণাম নিয়ে সর্তক করে দিয়ে। দু’টো শাদা সাপ এক নারীর স্তনযুগল থেকে ঝুলে আছে, ছোবল মারছে বুকে। আর যীশুর হাত থেকে একটা বর্শা নারীটির একটা স্তনের মাঝ দিয়ে বুক ফুঁড়ে ভিতরে চলে গেছেঃ প্রভু যীশু নারীটিকে হত্যা করছেন। মেয়েটি ভয়ে চীত্কার করে উঠল।
স্বামীর ক্ষতটি ভয়াবহ ছিল। নারীটিকে ক্ষমা করবার বদলে পুরুষটি আর তার পরিবার পুলিশকে সব জানাল। ফলে নারীটিকে গ্রেফতার করা হ’ল।
৫
নারীটি যখন জেলখানার অন্যান্য কয়েদিদের সাথে ছিল, স্বর্গের দরজা খুলে গেল এবং মেয়েটি ঈশ্বরের ছায়া দেখতে পেল।
৬
যখন নারীটি জেলখানায় ছিল, আর একজন অল্পবয়েসী মেয়েকে জেলখানায় কয়েদি করা হ’ল। এই অল্পবয়েসী মেয়েটি নিজের প্রেমিক-কে হিংসায় কান্ডজ্ঞানহারা হ’য়ে খুন করেছে। যখন মেয়েটি জানল যে নারীটির একটি সন্তান আছে, তখন তাকেও খুব ঈর্ষা করতে শুরু করল মেয়েটি।
“আমি আমার প্রেমিকের সন্তানের জন্ম দিতে চেয়েছিলাম খুব, কিন্তু এখন আর তা পারব না – আমি ওকে খুন করেছি।” নারীটিকে আঁকড়ে ধরে খুব কাঁদল মেয়েটি। “আর হবে না। এই জীবনে না। কোনদিন কারও সন্তানের জন্মই আমি আর দিতে পারব না। আমার জীবন এই জেলখানাতেই কেটে যাবে। আর যতদিনে জেলখানা থেকে বের হ’ব ততদিনে আমার এত বয়স হয়ে যাবে! সন্তানের জন্ম দেওয়ার সেই বয়স তো আর থাকবে না। একজন নারীর সেটাই তো মৃত্যুদন্ড। যখনই আমি এইকথা ভাবি, মনে হয় যদি কোনভাবে, যে কারও সন্তানের জন্ম যদি দিতে পারতাম। যে কোনভাবে।”
“যে কোনভাবে?”
“হ্যাঁ, যে কারও সন্তান।”
“তাই নাকি? এ কথা যদি সত্যি হয়, তবে আমি কি সেই চেষ্টা করব যাতে তুমি গর্ভবতী হও?”
“ কিন্তু তুমিও তো একজন নারী।”
“আমি কিছুদিনের ভিতরই এখান থেকে বের হ’ব। ততদিন অপেক্ষা কর। আমি তোমার সন্তানের জন্ম দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
৭
নারীটি জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যে মেয়েটি জেলখানায় পিছনে পড়ে থাকল, তাকে দেখতে এল।
জেলখানার মেয়েটি গর্ভবতী হ’ল।
এই ঘটনায় সারা জেলখানায় শোরগোল পড়ে গেল। নারীটি কিছুতেই স্বীকার করল না যে কার সন্তান এটা। আসলে এও সত্য যে এমন কোন পথই খোলা থাকল না যা দিয়ে নারীটি সে চেষ্টাটুকু শুরুও করতে পারে। জেলখানার সব প্রহরী এবং সব পুরুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হ’ল। কিন্তু নারী কয়েদিদের সব প্রহরীরাও মহিলা ছিল। কোন পুরুষ ওই নারীদের কাছে আসেনি। আর নারীটি কোনভাবেই জেলখানার বাইরেও যায়নি।
যে নান জেলখানার উপাসনাগারের দায়িত্বে ছিল সে একবারও বলল না যে এটা কোন এক অলৌকিক ঘটনা। কিংবা এমনও বলল না যে এ কোন পবিত্র আত্মার কাজ, কিংবা এবার কোন ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম হবে।
প্রশান্তিতে ভেসে গিয়ে নারীটি ওই শিশু কন্যাকে জেলখানার ভিতর বুকের দুধ খাইয়ে বড় করতে থাকল। সে তার বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখল।
অল্পবয়েসী অন্য নারীটি তাকে দেখতে আর দ্বিতীয়বার এল না।
৮
বাচ্চা মেয়েটিকে দত্তক নিল কেউ, সে সুখী হয়ে বড় হ’য়ে উঠতে থাকল। এই সেই মেয়ে যে এখন সেন্ট পল চার্চের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যখনই ইচ্ছে করত, তখনই সে নিজের আপন মা-কে দেখতে যেতে পেত। মা এখন জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছে। মেয়েটি জেলখানার ওই গরাদের ভিতর ওর নিজের জন্মকথা শুনেছে।
যে অল্পবয়েসী তরুণটি মেয়েটির সাথে এখন হাঁটছে, সে হচ্ছে সেই শিশু যাকে তার মা মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছিল। অবশেষে তরুণটির বাবা তার মাকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। ওদের আবার ভাব হয়ে গিয়েছিল এবং এখনও তারা একসাথেই আছে।
“যে আমাকে রক্ষা করেছিল আর নিজে আহত হয়েছিল, সেই বুঝি আমার বাবা?” তরুণটি স্বপ্নাচ্ছন্নভাবে বলল।
“ঠিক তাই।” মেয়েটি মাথা নাড়ল।“ আর আমি হচ্ছি সেই শিশু যার নিজের কোনদিন কোন বাবা ছিল না। সেই আমি আজ এমন এক সন্তানের জন্ম দেব যার পিতা আছে।”
তরুণটিও চার্চের সামনের রাস্তা ধরে যেতে যেতে মাথা নেড়ে সায় দিল।
৯
“আর সেই সাপটার মুখ থেকে বন্যার মত জলের স্রোত বেরিয়ে এল। সেই বন্যায় নারীটি যেন ভেসে যেতে নিল। পৃথিবী নারীটিকে সাহায্য করল। পৃথিবী নিজের বিবরে সেই বন্যার জল শুষে নিল। যে জল ওই ড্রাগনটা নিজের মুখ থেকে উগড়ে দিয়েছিল।”
(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন