প্রেমের আত্মহত্যা

মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা

মহিলাটির স্বামীর কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছে। প্রায় বছর দুয়েক হ’ল লোকটা তার স্ত্রীকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে আর ছেড়ে চলে গেছে। বহুদূর থেকে চিঠিটা এসেছে।

“মেয়েটাকে রবারের বল নিয়ে লোফালুফি করতে দিও না তো। শব্দটা কানে বাজে। আমার হৃত্‌পিন্ডে এসে ধাক্কা লাগে।”

মহিলাটি রবারের বলটা নয় বছরের মেয়েটার কাছ থেকে নিয়ে নিল।
আবার লোকটার কাছ থেকে চিঠি এল। এবার প্রথমবারের থেকে আলাদা অন্য একটা পোস্ট অফিস থেকে।

“বাচ্চাটাকে জুতা পরে স্কুলে যেতে দিও না। শব্দটা কানে বাজে। যেন আমার হৃত্‌পিন্ড মাড়িয়ে কেউ চলে যাচ্ছে।”

জুতার বদলে মহিলাটি তখন মেয়েটাকে নরম ফেল্টের স্যান্ডাল পরতে দিল। মেয়েটি কেঁদেকেটে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল।


মহিলাটির স্বামীর কাছ থেকে আর একবার চিঠি এল।
আগের চিঠির মাত্র একমাস পরেই পোস্ট করা হয়েছে এই চিঠি, কিন্তু লোকটির হাতের লেখাকে হঠাত্‌ করে কেন যেন একটা খুব বুড়ো মানুষের লেখার মত মনে হ’ল।

“বাচ্চাটাকে চীনামাটির বাটি থেকে খেতে দিও না তো। শব্দটা কানে বাজে। হৃত্‌পিন্ড ফেটে যায়।”

মেয়েটাকে নিজের চপস্টিক দিয়ে খাইয়ে দি’ল মহিলাটি, যেন ওর তিন বছর বয়স। তারপর মনে পড়ল যখন মেয়েটির বয়স সত্যিই তিন বছর ছিল। মনে পড়ল স্বামীর সাথে কাটানো সুখের দিনগুলোর কথাও। বাসনপত্র রাখবার আলমারিটার কাছে গিয়ে মেয়েটি নিজে নিজেই ওর বাটিটা বের করল। মহিলাটি এক ঝটকায় ওর কাছ থেকে বাটিটা নিয়ে তা বাগানের একটা পাথরে ছুঁড়ে মারলঃ শব্দটা ওর স্বামীর হৃত্‌পিন্ড চৌচির হ’য়ে যাওয়ার আওয়াজ। হঠাত্‌ মহিলাটি ভুরু কোঁচকাল। তারপর নিজের বাটিটাও পাথরটার গায়ে ছুঁড়ে দিল। এটাই তার স্বামীর হৃত্‌পিন্ড চৌচির হয়ে যাওয়ার শব্দটা না? খাবার ছোট টেবিলটা মহিলাটি বাগানে ছুঁড়ে মারল। আর এই শব্দটা? দেয়ালের গায়ে পুরো শরীরটা ছুঁড়ে দিল মহিলা, দুম্‌দুম্ করে হাতের মুঠো দিয়ে মারতে থাকল ও।
দু’টো ঘরের মাঝে যে কাগজের পার্টিশনটা আছে, তার গায়ে নিজেকে বর্শার মত ছুঁড়ে দিল। হুড়মুড় করে অন্য পাশে গিয়ে ছিটকে পড়ল তারপর। আর এই শব্দটা?

“মা, মা, মা!”
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে মহিলাটির কাছে ছুটে গেল। মেয়েকে এক থাপ্পড় মারল তখন মা। আহ্‌, এখন এই শব্দটা শোনো দেখি!

মহিলাটির স্বামীর কাছ থেকে আর একটা চিঠি এল, ওই শব্দের প্রতিধ্বনির মত। দূরের নতুন এক জায়গার অন্য এক পোস্টঅফিস থেকে পাঠানো হয়েছে এই চিঠি।

“একদম কোন শব্দ কর না। দরজা কিংবা স্লাইডিং পার্টিশন কিচ্ছু খোলা বা বন্ধ করবার দরকার নেই। নিঃশ্বাস নিও না। এমনকি বাড়ির ঘড়িগুলোকেও তোমরা দু’জন কোন শব্দ করতে দিও না যেন।

“তোমরা দু’জন, তোমরা দু’জন, তোমরা দু’জন।” মহিলাটি যখন ফিস্‌ফিস্‌ করে কথা বলছিলো, দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো ওর। তারপর দু’জন কোন শব্দ করল না। এমনকি খুব আস্তে কোন আওয়াজ করাও সারা জীবনের মত থামিয়ে দিল ওরা। অন্যভাবে বলতে গেলে, মা এবং মেয়েটা আসলে মরে গেল।

আর কী আশ্চর্য! তারপর মহিলাটির স্বামীও কিভাবে যেন ওদের দু’জনের পাশেই শুয়ে পড়ল আর মারা গেল।

(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ