শাদা ঘোড়া

মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা [১৯৬৩]
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা


ওক গাছের পাতায় রুপালি সূর্য ঝুলে আছে

মুখ তুলে সে আলোয় চোখ ঝলসে গেল নোগুচি-র। একবার পলক ফেলে আবার তাকাল ওওই আলো সরাসরি ঠিক চোখে এসে পড়ছে না; ঘন পাতার ভিতর আটকে যাচ্ছে যেন।

জাপানী ওক গাছ একটা। কিন্তু ওক হিসাবে গুঁড়িটা যেন একটু বেশি মোটাদাঁড়িয়েও আছে অনেক লম্বা হ’য়েআরো কিছু ওক গাছ ঘিরে আছে গাছটার চারপাশ। নীচের ডালগুলো ছাঁটা নয় বলে পশ্চিমের সূর্যকে আড়াল করে রেখেছে গাছগুলোআর ওক গাছের সারির পিছনে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে গরমকালের সূর্যটা

জালের মত ছড়িয়ে থাকা একরাশ ঘন পাতার জন্য পুরো সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে সূর্যটা বুঝি পাতার ভিতর আলো হয়ে নিজেকেই ছড়িয়ে দিচ্ছে। নোগুচি এইসব ছবি এভাবে দেখতেই অভ্যস্ত পাহাড়ের কাছে পাতার সবুজ রঙ পশ্চিমের ওক গাছগুলোর মতই উজ্জ্বল। আলো শুষে ওক গাছের পাতা এক অদ্ভুত ফ্যাকাশে সবুজ হয়ে গেছে, আর পাতার ভিতর দিয়ে যেন খুব সহজেই যাওয়া আসা করছে সেই আলো । যখনই বাতাস বইছে, ঠিক তখনই যেন তা থেকে এক ঝলমলে আলোর ঢেউ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

আজ সন্ধ্যায় গাছের পাতাগুলো আর নড়াচড়া করছে না। পাতার বুকের আলোটুকুও স্থির

“কী ওটা?” বেশ জোরে বলে উঠল নোগুচি। আকাশে গোধূলির রঙ এইমাত্র লক্ষ্য করল ও। উঁচু ওক গাছের সারির উপরে আকাশের মাঝামাঝি উঠে যাওয়া সূর্যের আলোয় আকাশের যে রঙ হয়, এ রঙ সে রঙ নয়। সূর্য ডুবে যাওয়ার সাথে, সাথে আকাশের যে রঙ হয়, এই রঙ সে রঙ। গাছের সারি পেরিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল একটা ছোট শাদা মেঘ। ডুবে যাওয়া সূর্যের আলো সেই মেঘে ঠিকরে পড়ে ওক গাছের পাতায় রুপালি রঙের আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর গাছের সারির বামদিকে ঢেউ-এর মত দূরের পাহাড় আলো হারাতে হারাতে ধীরে ধীরে বিবর্ণ, ঘন নীল হয়ে গিয়েছিল।

গাছের পাতায় যে রুপালি আলোর ঝিলিক ছিল তা হঠাত্‌ করে নিভে গেল। ঘন পাতার ভিতরের ওই সবুজ ধীরে ধীরে কালো হয়ে গেল। গাছের শিখরচূড়া থেকে একটা শাদা ঘোড়া এক লাফে উপরে উঠে এল, তারপর ধূসর আকাশের বুকে টগবগিয়ে চলে গেল।

“আহা...!”  কিন্তু নোগুচি খুব অবাক হ’ল না। ওর জন্য এটা খুব অস্বাভাবিক কোন স্বপ্ন যেন নয়।

“ও আবার ঘোড়ার পিঠে করে চলেছে। আর আবার সেই সারা শরীর মোড়ানো কালো পোশাক।”
ঘোড়ার দু’পাশে পা ঝুলিয়ে টগবগ করে যখন নারীটি চলতে থাকল, তখন বাতাসে আঁচলের মত ওর কালো উড়নি উড়তে থাকল। না তা ঠিক নয়। আসলে ওই দীর্ঘ কালো কাপড়টা যখন ওই তেজী ঘোড়ার ধনুকের মত বাঁকানো লেজের উপর দিয়ে পত্‌পত্‌ করে উড়ছিল, তখন মনে হচ্ছিল যে হয়ত তা ওই কালো পোশাকের সাথেই আটকানো আছে। শুধু দূর থেকে দেখে আলাদা বলে মনে হচ্ছে।

“কী ওটা?” ঠিক যখন নোগুচি এই কথাটা ভাবছিল, ওই দৃশ্য আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল। শুধু ঘোড়ার খুরের ছন্দটা ওর হৃদয়ে থেকে গেল। ঘোড়াটা যদিও রেসের ঘোড়ার মত টগবগিয়ে ছুটে যাচ্ছিল, ওর চলার ছন্দে যেন ছিল এক ধীর স্থির, দুলকি চাল। আর পা ছাড়া ওর সারা শরীর ছিল নিশ্চল। পায়ের খুরগুলো খুব ধারাল। “ওর পিঠের ওই কালো কাপড়টা কিসের? আর কে জানে ওটা কাপড় না অন্য আর কিছু?” নোগুচি খুব অস্বস্তির সাথে নিজেকেই প্রশ্ন করল।

খুব ছেলেবেলায় স্কুলে থাকতে নোগুচি তাকো-র সাথে বাগানে খেলা করত। করবী ফুলের হাল্‌কা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। ওরা একসাথে ছবি আঁকত। অনেক অনেক ঘোড়ার ছবি। একবার তাকো আকাশের বুকে টগবগিয়ে ছুটে চলা একটা ঘোড়া এঁকেছিল। নোগুচিও। 

“এই সেই ঘোড়া যে পাহাড়ের বুকে খুরের ঘা দিয়ে ঝর্ণার জন্ম দেয়। পবিত্র ঝর্ণা,” তাকো বলল।

“ওর ডানা কই?” – নাগুচির প্রশ্ন। নাগুচির আঁকা ঘোড়ার ডানা ছিল।

“নাহ্‌, ওর কোন ডানার দরকার নেই।” তাকোর উত্তর। “ওর তো খুরেই ধার আছে।”

“কে চলেছে ওই ঘোড়ায় চেপে?”

“তাকো। তাকো চলেছে। শাদা ঘোড়ায় চড়ে, আর পরনে গোলাপি পোষাক।”

“ওহ্‌, তাই নাকি? তার মানে তাকো এক ঘোড়ায় করে চলেছে যার খুরের ঘায়ে পাহাড়ের বুকে পবিত্র ঝর্ণার জন্ম হচ্ছে। আহা!”

“ঠিক তাই। তোমার ঘোড়ার ডানা আছে ঠিকই, কিন্তু কেউ ওই ঘোড়ায় চড়ে কোথাও যাচ্ছে না তো

“তবে এই নাও।” নোগুচি তাড়াতাড়ি ঘোড়ার উপরে একটা ছেলেকে এঁকে দিল। তাকো পাশে  দাঁড়িয়ে  দাঁড়িয়ে তা দেখল।

এই গল্পের শুধু এইটুকুই ছিল। নোগুচি তারপর অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করল। বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করল, ধীরে ধীরে ওর বয়স হ’ল আর তারপর এই ধরণের সব কথা ও ভুলে গেল।

এক গভীর রাতে সেদিন কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তখন হঠাত্‌ নোগুচির আবার এইসব মনে পড়ে গেল। নোগুচির ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি বলে প্রতি রাতে প্রায় রাত দু’টা, তিনটা পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করত। নোগুচি ছেলেকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় কিছুতেই ঘুমাতে পারত না। একের পর এক ঘুমহীন রাত যত কাটতে থাকত , তত  জীবনের একাকীত্বর মুখোমুখি হ’ত নোগুচি। ওর ছেলের জীবনে পরের বছরের স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল। এতই স্বপ্ন যে রাতে বিছানায় শুতে যাওয়ারও যেন কোন দরকার ছিল না। কিন্ত নোগুচি বাবা হ’য়ে বিছানায় কোনমতে জেগে জেগে রাতগুলো কাটিয়ে দিচ্ছিল। নাহ্‌, এই রাতজাগা ছেলের কথা ভেবে ভেবে নয়। নিজের জীবনের একাকীত্বকে অনুভব করছিল নোগুচি। একবার এই একাকীত্ব চেপে ধরলে আর কিছুতেই তো তা ঝেড়ে ফেলা যায় না। একদম যেন নোগুচির প্রাণের খুব গভীরে শিকড় বাকড় ছড়িয়ে বাসা বেঁধে ফেলছে এই পরম একাকীত্ব।

নোগুচি নানা উপায় খুঁজে খুঁজে অনেক ঘুমানোর চেষ্টা করল। শান্ত সব অলীক স্বপ্ন আর স্মৃতির কথাগুলো ভাবতে চাইল।  আর তারপর এক রাতে হঠাত্‌ করে ওর শাদা ঘোড়ার উপর তাকোর ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। যদিও খুব স্পষ্ট করে নয়। তবে কোন শিশুর আঁকা ছবি এ নয়। অন্ধকারে নোগুচির চোখের পাতার ভিতরে যে ছবি ভাসতে থাকল তা টগবগ করে স্বর্গের দিকে ছুটে যাওয়া একটা শাদা ঘোড়ার।

“তাকো চলেছে নাকি? ঘোড়ার পিঠে করে? পরনে গোলাপি পোশাক?”

আকাশের মাঝ দিয়ে টগবগ করে ছুটে যাওয়া ওই শাদা ঘোড়ার শরীরটা খুব স্পষ্ট ছিল। কিন্তু ঘোড়ার পিঠে যে কে বসে আছে তা ভালো বোঝা যাচ্ছিল না। কে জানে কী তার চেহারা, কী তার গায়ের রঙ। অথচ মনে হ’ল না  কিন্তু যে সেটা কোন মেয়ের ছবি।

এইভাবে ধীরে ধীরে ঘোড়াটা শূন্য আকাশের ভিতর দিয়ে টগবগ করতে করতে চলে গেল, এই দৃশ্যটা আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল। আর নোগুচির চোখে ঘুম নেমে আসল। 

সেই রাতের পর থেকে ঘুমিয়ে পড়বার জন্য নোগুচি ওই শাদা ঘোড়ার কথাটাই ভাবত। এবং এই নিদ্রাহীনতা নোগুচির প্রতিদিনের জীবনের ঘটনা হয়ে গেল। যখনই অস্থিরতা ওর মনের ভিতর ছড়িয়ে পড়ত, ঠিক তখনই  অমন হ’ত। 

তারপর বেশ কিছু বছর কেটে গেল। ওই শাদা ঘোড়ার ছবি ওকে নিদ্রাহীনতা থেকে বাঁচিয়ে রাখল। কল্পনার ওই শাদা ঘোড়া কী ভীষণ জীবন্ত আর উচ্ছল। কিন্তু কেমন যেন মনে হ’ত যে ঘোড়ার পিঠে বুঝি কালো পোশাক পরে এক নারী বসে আছে। গোলাপি পোশাক পরা কোন ছোট মেয়ে যেন সে নয় আর। যত সময় যেতে থাকল, কালো পোশাক পরা ওই নারীর মূর্তি আরও বেশি বয়স্ক, দুর্বল, রহস্যময় হয়ে উঠল। 

অথচ আজই প্রথম এমনটা ঘটল। নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে আর নয়, এবার একটা চেয়ারে বসে দু’চোখ পুরো খুলে ওই শাদা ঘোড়ার স্বপ্নটা দেখল নোগুচি। এই প্রথমবার ওর খোলা চোখের উপর দিয়ে কালো উড়নি উড়িয়ে নারীটি চলে গেল। যদিও বাতাসে পতপত করে ওই উড়নি উড়ছিল, তা আসলে বেশ ভারিই ছিল।

“কী ওটা?”

ধীরে ধীরে কালো হয়ে আসা ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল নোগুচি। সেই আকাশের বুক থেকে ততক্ষণে শাদা ঘোড়াটা মিলিয়ে গেছে।

নোগুচি তাকো-কে চল্লিশ বছর দেখে নি। ওর কোন খবর আর কেউ জানে না।

(লেন ডানলপের ইংরেজী অনুবাদ থেকে)

http://www.copyleftwebjournal.tk/

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ