সংসার

মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা

যে অন্ধত্বের কথা বলছি এখানে, তা শুধু চোখের অন্ধত্ব নয়।
ভাড়া নেওয়ার জন্য বাড়ি দেখাতে এনে লোকটি অন্ধ স্ত্রীর হাত ধরে ধরে তাকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে গেল।
“কিসের শব্দ?”
“বাঁশবনে বাতাসের।”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই। আসলে সে আজ কত বছর যে হয়ে গেছে আমি বাড়ি থেকে বের হইনি। ভুলেই গেছি বাঁশপাতার খসখস শব্দ কেমন হয়...জানো, আমরা এখন যে বাড়িটায় থাকি, তার সিঁড়িগুলো এত সরু। যখন প্রথম ওই বাড়িটায় এসেছিলাম, কিভাবে যে সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করব সে কায়দাটাই বুঝে উঠতে পারতাম না। কিন্তু এখন যেই ওই সিঁড়িগুলোতে অভ্যস্ত হ’য়ে উঠেছি, তুমি আবার একটা নতুন বাড়ি দেখতে যাচ্ছ। যে অন্ধ সে তো নিজের বাড়ির সব কোণাকাণাগুলোই জানে। ঠিক নিজের শরীরকে যেভাবে চেনে। যারা দেখতে পায়, তাদের কাছে একটা বাড়ি মৃত। কিন্তু অন্ধের কাছে তো তা জীবন্ত। যেন বাড়িটার একটা নাড়ির স্পন্দন আছে।কিন্তু এখন নতুন বাড়িতে গেলে সদর দরজার মুখে, থাম্বা, খুঁটিতে আবার তো আমি হোঁচট খেয়ে পড়ব।”
স্ত্রীর হাত ছেড়ে দিয়ে, লোকটি চুনকাম করা শাদা দরজাটা খুলল।
“অন্ধকার লাগছে, বাগানে গাছগুলো যেন বড় বেশি বেড়ে গেছে। এখন থেকে শীতকালগুলো ঠান্ডা হ’বে,” মেয়েটি বলল।
“পাশ্চাত্য কায়দার বাড়ি এটা। দেয়াল আর জানালাগুলো বিষন্ন। নিশ্চয়ই আগে জার্মানরা এখানে থাকত। বাড়ির ফলকে দেখছি লেখা আছে,‘লিডারম্যান।’”

সদর দরজা ঠেলে খুলতেই, লোকটি কয়েক পা পিছিয়ে গেল, এক তীব্র আলোর চোখ ঝলসানিতে।
“আহ্, অপূর্ব!কি উজ্জ্বল!হয়ত বাগানে এখন রাত, কিন্তু বাড়ির ভিতরে তো দেখছি ভরদুপুর।”
হলুদ আর সিঁদুর রঙের ডোরাকাটা ওয়্যালপেপার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ঠিক উৎসবের শাদা আর টকটকে লাল পর্দার মত। উজ্জ্বল লাল পর্দাগুলো রঙিন বৈদ্যুতিক বাতির মত ঝলমল করছিলো।
“সোফা, ফায়ারপ্লেস, টেবিল, চেয়ার, লেখার টেবিল, একটা সৌখিন ল্যাম্প। দেখ, দেখ সব আসবাবপত্রই এখানে আছে!” লোকটি মেয়েটিকে জোর করে সোফায় বসাতে গিয়ে ওকে প্রায় উল্টে ফেলে দিল। এক আনাড়ি আইস স্কেটারের মত মেয়েটি হাতদু’টো দুই পাশে চিৎ করে ছড়িয়ে দিয়ে একটা স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল।
““ইস্ রে, একটা পিয়ানো পর্যন্ত আছে।” লোকটি ওর হাত ধরে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসল। ফায়ারপ্লেসের পাশে ছোট পিয়ানোটার সামনে মেয়েটি বসল। খুব আলতো করে পিয়ানোর কি-গুলো ছুঁয়ে দেখতে গেল। যেন ওগুলো ভয়ংকর একটা কিছু।
“আরে আরে, বাজছে দেখ!” একটা খুব সহজ সুর বাজাতে শুরু করল মেয়েটি। কে জানে হয়ত এই গানটা ও শিখেছিলো যখন ও খুব ছোট ছিল। কি জানি হয়ত তখন ও চোখেও দেখতে পেত।
লোকটি পড়বার ঘরে গিয়ে দেখে একটা বড় ডেস্ক সেখানে। আর পড়বার ঘরের পাশেই শোওয়ার ঘর। দুই জনের বড় বিছানা সেখানে। এখানেও আবার সেই শাদা আর সিঁদুরে ডোরাকাটা দাগ – এবার জাজিমের উপর পাতা খসখসে কম্বলটায় সেই রঙ। লোকটি লাফ দিয়ে গদির উপর উঠে বসল। নরম আর স্প্রিং দেওয়া গদি। লোকটির স্ত্রীর পিয়ানোর সুর আরো আনন্দময় হ’য়ে উঠল। অবশ্য মাঝে মাঝে ওকে বাচ্চা মেয়ের মত খিলখিল করে হেসে উঠতেও শোনা গেল। হঠাৎ করে যখন কোন একটা সুর ভুল হ’য়ে গেল – অন্ধত্বের দুঃখ।
“এই যে, এ ঘরে এসে বড় বিছানাটা দেখে যাও।”
আশ্চর্য, যেন চোখে দেখতে পাচ্ছে! মেয়েটি ওই অদ্ভুত বাড়ির ভিতর দিয়ে দ্রুত হেঁটে সোজা শোওয়ার ঘরে এসে হাজির হ’ল।
ওরা একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরল। বিছানায় বসতে যেতেই লোকটি এমন কান্ড করল যে মেয়েটি জ্যাক-ইন-দা-বক্সের মত লাফিয়ে উঠল। আস্তে আস্তে শিস দিতে শুরু করল ও। সময় ভুলে গেল ওরা।
“এই জায়গাটা কোথায়?”
“আসলে...”
“সত্যি, কোথায় এ জায়গাটা?
“তা যেখানেই হোক না কেন, কোনভাবেই এটা তোমার বাড়ি নয়।”
“কি ভালোই যে হ’ত যদি এমন অনেক, অনেক জায়গা থাকত!”

(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ