বরফের দেশ থেকে টুকরো খবর(১৯৭২)



সীমান্তের দীর্ঘ সুড়ঙ্গের পরে, বরফের দেশের দেখা মিলল। রাত্রির গভীরতার রং সাদা। সিগন্যালে ট্রেনটা থামল।  

একটা মেয়ে সামনের সীট থেকে উঠে দাঁড়াল। সিমামুরার সামনের জানালাটা খুলে দিল। বরফ ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ল। মেয়েটা জানালা থেকে ঝুঁকে পড়ে দূরের দিকে তাকিয়ে ডাকতে থাকল, “স্টেশনমাষ্টার! স্টেশনমাষ্টার!

স্টেশনমাষ্টার বরফের উপর দিয়ে ভারী পদক্ষেপে হাতে একটা লন্ঠন নিয়ে এগিয়ে এল। নাক পর্যন্ত মাফলারে ঢাকা। টুপির ফ্ল্যাপ কানের উপরটা ঢেকে রেখেছে। 

সিমামুরা স্থির দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই কি অতটা ঠান্ডা? রাস্তা বানানোর মজুরদের থাকবার জন্য যে ব্যারাক, তা পাহাড়ের পায়ের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু অন্ধকার বরফের সাদা রঙটুকু গিলে খেয়েছে, সে রঙ ব্যারাকের কাছে পৌঁছানোর আগেই।
প্রায় ঘন্টা তিনেক পরে, একঘেয়েমি কাটাতে শিমামুরা নিজের বাম হাতের তর্জনীটা নাড়াতে নাড়াতে তর্জনীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। যার সাথে দেখা করবার জন্য বের হয়েছিলো শিমামুরা, সেই নারীকে শেষপর্যন্ত শুধু এই আঙ্গুলটাই খুব পরিষ্কারভাবে মনে রেখেছে। নারীটিকে যত স্পষ্টভাবে মনে করবার জন্য সে চেষ্টা করতে থাকল, ততবেশি উদ্ভট মনে হ’ল যে এখন একা এই আঙ্গুলটাই শুধু ভেজা থাকবে মেয়েটির স্পর্শেএবং তাকে টেনে নিয়ে যাবে সুদূরের সেই নারীর দিকে। ধোঁয়াটে স্মৃতির দৃঢ় মুঠো থেকে সে নারী হারিয়ে যেতে থাকলেও। শিমামুরা আঙ্গুলটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখতে নিল। তারপর সেই আঙ্গুল দিয়ে জানালার কাচের উপর একটা দাগ কাটল। সেখানে এক নারীর চোখ ভেসে উঠল। শিমামুরা এত্ত চমকে উঠল যে প্রায় চীত্‌কার ক’রে ওঠে আর কী। কিন্তু সে তার মন অন্য কোথাও ছিল ব’লে। তারপর যখন সম্বিত ফিরে পেল, বুঝতে পারল এ কিছুই না। তার মুখোমুখি বসে থাকা মেয়েটির ছায়া গাড়ির অন্যপাশে। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। ট্রেনের ভিতর আলো জ্বলছিলো- জানালার কাচটা আয়নার মত হয়ে গেছে। কিন্তু জলের বাষ্পে ধোঁয়া ধোঁয়া সব। তাই নিজ আঙ্গুল দিয়ে না মোছা পর্যন্ত আয়নাটা দেখা যায় নি।
 

সন্ধ্যার দৃশ্যপট আয়নার গভীরতায় বয়ে গেল। আয়নাটা এবং যা কিছু আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছিল, সব ডাবল-এক্সপোসড মোশন পিকচারের মত দুলতে থাকল। দুলতে থাকল অভিনেতা এবং দৃশ্যপটের সাথে কোন সম্পর্ক না রেখেই। তার উপর, পরিবর্তনশীল স্বচ্ছতায় অভিনেতা এবং কুয়াশা জড়ানো প্রবহমানতায় দৃশ্যপট - যখন এই দু’টো একসাথে জোড়া লেগে গেল, তখন তারা এক অপার্থিব প্রতীকী পৃথিবী গড়ে তুলল। বিশেষতঃ যখন মাঠের ভিতর থেকে, পাহাড়ের ভিতর থেকে আলো এসে মেয়েটার মুখের মাঝামাঝি এসে ঝিলিক দিয়ে গেল, তার হৃদয় এক অপার্থিব সৌন্দর্যে কেঁপে উঠল


পাহাড়ের উপরে দূরের ওই আকাশে তখনও সূর্যাস্তের চিহ্ন লেগে আছে। তাই সে জানালার ফাঁক দিয়ে দূরের দৃশ্যের ছবিও আঁকতে পারছিল। যদিও রঙগুলো বিবর্ণ হ’য়ে গিয়েছিল। যতদূর চোখ যায়, সাধারণ পাহাড় আর মাঠগুলোর প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যকে আরো বেশি সাধারণ ব’লে মনে হচ্ছিল। কিছুই যেন চোখে পড়বার মত নয়, কিছুই তাই নজর কাড়ল না। সবকিছু যেন বয়ে যাওয়া অনুভূতির মত। আসলে মেয়েটির চোখ এই সবকিছুর মাঝে ভাসছিল। জানালার আয়নায় মেয়েটির মুখের অপরূপ প্রতিকৃতিকে ছাড়িয়ে সন্ধ্যার দৃশ্য এগিয়ে যেতে থাকল। মেয়েটির মুখটিকেও যেন স্বচ্ছ বলে মনে হ’তে থাকল। কিন্তু সে আরো বেশীক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারল না যে পিছনে যে দৃশ্য অন্তহীন বয়ে চলেছে, এইসব তারই অংশ কিনা। কেননা মেয়েটির মুখ তার সামনে ভেসে উঠছিল।


ট্রেনটা ভিতরে খুব হালকা ছিল না। আর জানালাটা একটা সত্যিকারের আয়নার মত শক্তিশালী ছিল না। আর কোন প্রতিফলন ছিল না দেখে সিমামুরা ধীরে ধীরে ভুলে গেল যে ওখানে একটা আয়না ছিল আর সে তাতে উঁকিঝুকি দিচ্ছিল। সে কল্পনা করতে শুরু করল যে সন্ধ্যার দৃশ্যপটে মেয়েটি ভেসে বেড়াচ্ছে।


তারপর মেয়েটির মুখের মাঝামাঝি একটা আলো জ্বলতে থাকল; ওই প্রতিফলিত ছায়া বাইরে থেকে আসা আলো ঢেকে দেওয়ার মত শক্তিশালী ছিল না। আর আলোটা প্রতিফলিত ছায়াকেও মুছে ফেলল না। ফলে আলোটা মেয়েটার মুখের এপাশ থেকে ওপাশ ভেসে বেড়াতে থাকল। কিন্তু ওর মুখটাকে তা আরো উজ্জ্বল করে তুলল না। দূরের ঠান্ডা এক আলো ছিল ওটা। যখন ওর চোখের মণির উপর তা ঝিলিক দিয়ে উঠল, অন্যভাবে বলতে গেলে যে মুহুর্তে ওই আলো আর মেয়েটির চোখ একে অপরের উপর হ’ল-ওর চোখ রাতের অন্ধকারের ঢেউ-এ ভেসে বেড়ানো এক অপূর্ব, মোহনীয়,জ্বলন্ত পোকাতে যেন পরিণত হ’য়ে গেল।


স্কি সিজন শুরু হওয়ার আগে গরম ঝর্ণার পাশের সরাইখানায় খুব অল্প কয়েকজন অতিথি ছিল। শিমামুরা যখন স্নান সেরে উঠল, পুরো সরাইখানা ততক্ষণে ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। প্রাচীন হলওয়ের দিকে এক পা ফেলতেই কাচের দরজাগুলো আস্তে আস্তে ঝনঝন ক’রে উঠল। ডেস্কের কাছে দূরে হলঘরের কোণায় মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। কালো, দ্যুতিময়, ঠান্ডা কাঠের মেঝেতে তার কিমৌনৌর স্কার্ট ছড়িয়ে পড়ে আছে।

 
ও কি গেইশ্যা হ’য়ে গেল?মেয়েটির কিমৌনৌর  স্কার্ট দেখে চমকে উঠল শিমামুরা। মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এল না, তাকে সম্ভাষণ করবার জন্য নম্র ভঙ্গীতেও দাঁড়াল না। কিছুটা দূর থেকেও শিমামুরা নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার চেহারায় এক গাম্ভীর্য খুঁজে পেল। তাড়াতাড়ি ক’রে সে মেয়েটির দিকে যেতে নিল। মেয়েটি হাসতে চেষ্টা করতেই তার সাদা রঙ ক’রা মুখ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওরা দু’জন তখন নিঃশব্দে শিমামুরা্র ঘরের দিকে হাঁটতে থাকল।


ওদের দু’জনের মধ্যে যা কিছুই হোক না কেন, শিমামুরা তবু ওকে চিঠি লেখেনি, কিংবা দেখতে আসেনি, এমন কি প্রতিজ্ঞামত নাচশেখার বইটা পাঠায় নি। মেয়েটির মনে করাই স্বাভাবিক যে তাকে ভুলে গেছে শিমামুরা, এখন ক্ষমা চাওয়ার কথা শিমামুরারই। কিন্তু যখন ওরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে না তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, শিমামুরা বুঝতে পারল, তাকে আক্রমণ ক’রা তো দূরের কথা, একদিন যে বাসনায় ভরা ছিল মেয়েটির শরীর, আজও সেই একই আকুল আকাঙ্ক্ষায় ভরা তার পুরোটা শরীর। মনে হ’ল এখন যে কথাই  বলুক না কেন, তা বড় তুচ্ছ শোনাবে। তার চেয়ে বরং মেয়েটি নিজের মত করে ভাবুক যা চায়। এভাবে ভাবতে পেরে তার মনটা আনন্দে ভরে গেল। তারপর হঠাত্‌ সিঁড়ির মুখে সে মেয়েটির সামনে তর্জনী এগিয়ে বাম হাতটা বের ক’রে বলল, “তোমাকে সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে এই হাত।”

“তাই নাকি?” সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে আঙ্গুলটা আঁকড়ে ধরে এক টান দিল মেয়েটি। কয়লা রাখার পাত্রের সামনে হাতটা ছেড়ে দিয়ে লজ্জায় অল্প আরক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু যেন সে খেয়াল না ক’রে সেভাবে শিমামুরার হাতটা আবার তুলে নিল । “এই হাত আমাকে মনে রেখেছে?”

“নাহ্‌, ডান হাত নয়।” মেয়েটির হাত থেকে ডান হাতটা টেনে নিয়ে নিজের বাম মুঠিটা বাড়িয়ে দিল শিমামুরা।

মেয়েটির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “তাইতো দেখছি।” হেসে মেয়েটি শিমামুরার আঙ্গুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে তার হাতের তালুতে নিজের মুখটা চেপে ধরল। “এ কি আমাকে মনে রেখেছে?”

“উফ্‌, কী ঠান্ডা। কোনদিন তোমার চুল এত ঠান্ডা দেখি নি।”

“টোকিওতে এখনও বরফ পড়েনি। পড়েছে কি?”


শিমামুরা সদর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পান্থশালার পিছনে পাহাড়টার দিকে তাকাল যেখান থেকে নতুন পাতার জোরালো গন্ধ ভেসে আসছে। সে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকল। পাহাড় যেন তাকে হাতছানি দিচ্ছে। এত মজাদার কী ছিল ওখানে? পুরোটা সময় শিমামুরা হাসি থামাতে পারল না।

কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত হ’য়ে শিমামুরা ঘুরে দাঁড়াল, তারপর কিমৌনৌটা উঁচু ক’রে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে থাকল। দু’টো হলুদ প্রজাপতি তার পা’র কাছ ঘেঁষে উড়ে গেল।

প্রজাপতিগুলো এঁকেবেঁকে ধীরে ধীরে সীমান্তের পাহাড়ের উপরে এত দূরে চলে গেল যে তাদের হলুদ রঙ সাদা বলে মনে হ’ল।

“কী করছিলে তুমি?” সীডার বনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। “এত্ত খুশী হ’য়ে হাসছিলে!”

“হাল ছেড়ে দিলাম।”  আবার সে অর্থহীন হাসতে থাকে। “হাল ছেড়ে দিলাম।”

“সত্যি?”মেয়েটি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে সীডার বনের দিকে যেতে থাকে। শিমামুরাও নিঃশব্দে তার পিছনে পিছনে।

কাছেই ছিল শিন্টো প্রার্থনালয়। মেয়েটি প্রার্থনালয়ের শেওলা ঢাকা দু’টো কুকুরের মূর্তির পাশে একটা মসৃণ পাথরের উপর বসে পড়ল। “সবচেয়ে ঠান্ডা এই জায়গাটা। এমন কী গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝিও এখানে শীতল বাতাস বয়ে যায়।”

“এখানকার সব গেইশ্যা কি এমন?

“হ্যাঁ, তা সে বলতে পার। বয়স্ক কয়েকজন মহিলা খুবই ভালো।।” সে চোখ নামিয়ে রূঢ়ভাবে বলল। শিমামুরা ভাবল সীডারের ঘন সবুজ রঙ তার ঘাড়ে যেন প্রতিফলিত।

সীডারের উঁচু ডালগুলোর দিকে তাকাল শিমামুরা। “ঠিকই আছে। তবে আমার সব শক্তি আমার শরীর থেকে উধাও। বড় অদ্ভুত।”

সীডার গাছগুলো এত লম্বা যে পিছনের দিকে না বেঁকে গাছের মাথা ওরা দেখতে পাচ্ছিল না। গাছের সোজা কান্ডগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, ঘন কালো পাতা আকাশ ঢেকে দিয়ে। স্তব্ধতা যেন প্রতিধ্বনিত হ’য়ে ফিরে আসছে। যে গাছে ভর দিয়ে শিমামুরা দাঁড়িয়েছিল তা সবচেয়ে পুরনো গাছগুলোর একটা। কোন কারণে উত্তরদিকের সব ডালগুলো মরা আর তাদের ডগাগুলো ভাঙ্গা। ডালগুলোর অবশেষের দিকে তাকালে মনে হয় যেন কান্ডের মাঝ থেকে সারি সারি কাঠি বেরিয়ে আছে, তীক্ষ্ণ শলাকাগুলো বাইরের দিকে, ঈশ্বরের ভয়ংকর অস্ত্রের মত।

মেয়েটি দূরের নদীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, নদীতে সূর্যাস্তের ছটা প্রতিফলিত হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছিল মেয়েটির। “ওহ্‌, ভুলে গিয়েছিলাম। এই যে তোমার তামাক,” পরিস্থিতি হালকা করবার জন্য মেয়েটি বলল। “কিছুক্ষণ আগে যখন তোমার ঘরে গিয়েছিলাম, তুমি ছিলে না। ভাবছিলাম তুমি কোথায় গেলে, তখন দেখি তুমি বীর বিক্রমে একা একা পাহাড় বেয়ে উঠছ। আমি জানালা থেকে তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এত অদ্ভুত লাগছিল। তুমি মনে হ’য় তোমার তামাকের কথা ভুলে গিয়েছিলে, তাই আমি নিয়ে এলাম।”

কিমৌনৌর হাতার ভিতর থেকে সে তামাক বের ক’রে একটা দিয়াশলাই জ্বালাল।

“আমি ওই মেয়েটার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করি নি।”

“সে তো অতিথির মর্জি-কখন চলে যেতে বলবে বা না বলবে।”

নুড়ি পাথর ভরা নদীটায় কুলুকুলু ক’রে যে জল বয়ে যাচ্ছে তার শব্দটা মিষ্টি, ভরাট ।সীডার গাছগুলোর ডালপালার ভিতর দিয়ে যেখানে অন্ধকার গাঢ় হ’য়ে গেছে তারও ওপারে পাহাড়ের ফাটলগুলো ওরা দেখতে পাচ্ছিল।

(চলবে)


 



 




মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ