হাসান আজিজুল হকের লেখা ভূমিকা। 'হাতের পাতায় গল্পগুলো' বইটির জন্য।

অনুবাদের নিজস্ব মহিমা
----------------------------------


সরল সৌন্দর্য, চাপা দীপ্তি আর অপূর্ব সুষমা জাপানি শিল্প সাহিত্যের ঐতিহ্য। দুই একটি ওই দেশের প্রাচীন গ্রন্থও আমরা সবাই পড়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়েছে তার আশ্চর্য স্বপ্নময় বিশিষ্টতা, এমনকি যে সমস্ত সাহিত্যে ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ আছে তাও কেমন যেন অস্পষ্ট কুয়াশায় ঘেরা বলে মনে হয়। এই বৈশিষ্ট্য জাপানের সর্বপ্রকার কর্মময় জগতের শিরা উপশিরার মধ্যে। সেখানে যেন এই রকম আবছা অস্পষ্ট সৌন্দর্য বইছে। ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখন আমাদের যৌবনকাল। তার দু’ একটি গ্রন্থ সংগ্রহ ক’রে পড়ে এত অভিনব ঠেকেছিল যে আজও সেই যাদুকাঠির স্পর্শ মনে থেকে গেছে।
আর এক আশ্চর্য প্রথা, যে প্রথা বিশাল সম্মান বহন ক’রে আনে সে হ’ল আত্মহত্যা প্রথা। এই আত্মহত্যাটাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে আত্মহত্যা পাপ তো নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্য কল্যাণকর। সাধারণতঃ আমরা আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে জ্ঞান করি। অথচ জাপানে এক মহৎ কর্তব্য হিসাবে আত্মহত্যা বিবেচিত হয়। কাওয়াবাতাও আত্মহত্যা করেছিলেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কয়েক বছর পর। ওঁদের বিশেষ পদ্ধতি হারা-কিরি। উদরে ছুরি ঢুকিয়ে সমস্ত ভিতরটা একেবারে তছনছ ক’রে দেওয়া। আজও আমরা ঘৃণ্য কর্ম অনুষ্ঠিত হ’তে দেখলে ভিক্ষুদের আত্মহত্যার কথা জানতে পারি। এমন স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত ঐতিহ্য যে জাতির মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে রয়ে গেছে, তার শিল্পসাহিত্যেও যে একই বিশিষ্টতা চিহ্নিত হবে সন্দেহ নেই। এর মধ্যে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার স্থান সর্বোচ্চে। তার ‘দি স্নো কান্ট্রি’, ‘থাওজেন্ড ক্রেনস’ ইত্যাদি বই খুব যত্ন ক’রে পড়েছি আর তাদের সুষম সৌন্দর্যের চরম আবিষ্টতায় মজেছি।
এখানে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার কিছু গল্প বাংলায় অনুবাদিত হয়েছে। সরাসরি জাপানি ভাষা থেকে নয়, তার ইংরেজি থেকে। কাজেই অনুবাদের অনুবাদ মূল থেকে অনেকটাই দূরে থেকে যাবে তাতে সন্দেহ নেই, তবু কল্যাণী রমার এই অনুবাদ সুগন্ধি ফুলের পাপড়ির মতোই আমাদের মনকে স্পর্শ ক’রে যায়। কাঠিন্য এবং লৌহ-তন্তু-জাল বাংলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ নয়, এই ভাষায় কোমলতা আছে, সুষমা আছে, ঐশ্বর্যও আছে। কল্যাণী রমা কাওয়াবাতার গল্পগুলির ইংরেজি অনুবাদের বাংলা অনুবাদ করেও এই কথাটা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনুবাদগুলি সত্যিই অতিশয় সুপাঠ্য হয়েছে। আশ্চর্য হয়ে যাই রমার অনুবাদের ভাষার সাবলীলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য দেখে। ভাষার ভিতরের সৌন্দর্য অনুধাবন না করতে পারলে এমন বাংলা লেখা সম্ভব নয়। আমি অনুবাদগুলি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। রমাকে কল্যাণী বলে ডাকতে পারার আগ থেকে সে কল্যাণী রমা হয়ে রয়েছে। তার চির কল্যাণ কামনা করি।
হাসান আজিজুল হক
উজান, বিহাস, রাজশাহী

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ